WBBPE: TET প্রশ্ন ভুল মামলায় হাইকোর্ট গঠিত কমিটিতে মতপার্থক্য, প্রশ্ন সাতটির উপরে জটিলতা বেড়েছে

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত ইস্যু প্রাথমিক টেট (TET) পরীক্ষার প্রশ্ন ভুল মামলা। ২০১৭ ও ২০২২ সালের টেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল থাকার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এবার নতুন মোড়। এই মামলায় হাইকোর্ট গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের মধ্যেই মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, যা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষামহল। এই প্রশ্ন ভুল মামলা না মেটা পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়।



কি বলছে মামলার ইতিহাস?

২০১৭ এবং ২০২২ সালের প্রাথমিক টেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বহু পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন যে একাধিক প্রশ্ন ভুল ছিল। সেই দাবির ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়। বিচারপতি সৌমেন সেন এবং বিচারপতি প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন, যাতে সদস্য হিসেবে ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা। অবশেষে প্রশ্ন ভুল মামলা নিয়ে এই কমিটির মধ্যে তৈরি হয়েছে মতবিরোধ।

কমিটিতে প্রথম থেকেই বিভেদ

কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালের টেট পরীক্ষার ২৩টি প্রশ্ন নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের টেট পরীক্ষার ২৪টি প্রশ্নের মধ্যে ৭টি প্রশ্ন নিয়ে কমিটির সদস্যরা একমত হতে পারেননি। এই প্রশ্নগুলো ভুল আছে বলে কমিটি মনে করছেন। বিশেষ করে পর্ষদের সদস্যরা বাকি দুই সদস্যের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এর ফলে পর্ষদের পক্ষ থেকে আদালতে দাবি করা হয়েছে যে কমিটিতে বিষয়ভিত্তিক (subject expert) বিশেষজ্ঞ নেই। তাই কমিটির পুনর্গঠন কিংবা নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন আছে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ

ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে পরবর্তী শুনানির দিনে কমিটির রিপোর্ট তথা রেজলিউশন আদালতে জমা দিতে বলা হয়েছে। এই রিপোর্ট বিশ্লেষণ করার পরই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে যে কমিটির সদস্য পরিবর্তন বা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে কিনা।

মামলাকারীদের দাবি

মামলাকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে রাজ্যের বাইরে থেকে নিরপেক্ষ এবং উচ্চ মানের বিশেষজ্ঞদের এই কমিটিতে রাখা হোক। তাদের বক্তব্য, রাজ্যের মধ্যে থাকা বিশেষজ্ঞদের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। রাজ্যের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করলে সিদ্ধান্তে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে।

টেট পরীক্ষার্থীদের দুর্দশা

এই মামলার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী যাঁরা বছরের পর বছর ধরে এই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন। বারবার পরীক্ষা, ফলাফল, মেরিট লিস্ট ও নিয়োগের উপর স্থগিতাদেশের কারণে তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। শিক্ষামহল মনে করছে যে দ্রুত সমাধান না হলে আগামী দিনে শিক্ষক স্বল্পতার সমস্যাও আরও প্রকট হবে।

ভুল প্রশ্নের সম্ভাব্য প্রভাব

  1. ফলাফল বাতিলের আশঙ্কা: যদি আদালত রায় দেয় যে প্রশ্ন ভুল ছিল, তবে সেই প্রশ্নের নম্বর বাতিল বা সংশোধন হতে পারে। এর ফলে সম্পূর্ন রাখাল বা উত্তরপত্র বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং নতুন করে উত্তরপত্র তৈরি হতে পারেনা।

  2. মেরিট লিস্টে পরিবর্তন: প্রশ্ন বাতিল বা সংশোধন হলে মেরিট লিস্টেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।

  3. নিয়োগে বিলম্ব: এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে না। ফলে রাজ্যের স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট আরো বাড়বে।

সরকারের অবস্থান

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বক্তব্য, এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার যাতে রাজ্যে শিক্ষার স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা চায় যে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত যেন না হয় যাতে পরবর্তীতে নতুন মামলা তৈরি হয় বা আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়। তাই পর্ষদ চায় বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশ্নগুলির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন।

আইনি দিক

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও প্রশ্ন ভুল হলে পরীক্ষার্থীদের ফলাফলের উপর তা সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে আদালতের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে কমিটিতে মতবিরোধ থাকলে আদালতের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আদালত হয়তো নতুন কমিটি গঠন অথবা বর্তমান কমিটিতে নতুন সদস্য সংযোজনের নির্দেশ দিতে পারে।

শিক্ষামন্ত্রকের বক্তব্য

রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ মেনেই রাজ্য সরকার কাজ করবে। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন যে বছরের পর বছর ধরে টেট পরীক্ষার মামলা আদালতে চলতে থাকলে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাবে, যার খেসারত দিচ্ছেন রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা।

টেট মামলার ভবিষ্যৎ কোন দিকে?

✔️ কমিটির পুনর্গঠন হতে পারে
✔️ নতুন বিশেষজ্ঞ নিয়োগের সম্ভাবনা
✔️ নতুন করে রিপোর্ট তৈরির আদেশ
✔️ রায়ের আগে নিয়োগে স্থগিতাদেশ বহাল
✔️ মেরিট লিস্ট পরিবর্তনের সম্ভাবনা


বিষয় তথ্য
মামলা ২০১৭ ও ২০২২ সালের টেট প্রশ্ন ভুল সংক্রান্ত
প্রশ্নের সংখ্যা (বিতর্কিত) ২০১৭ – ২৩টি, ২০২২ – ২৪টি (এর মধ্যে ৭টি নিয়ে মতবিরোধ)
গঠিত কমিটি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী
নতুন দাবি কমিটি পুনর্গঠন/ বাইরের বিশেষজ্ঞ যোগ
আদালতের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ, পরবর্তী সিদ্ধান্ত তখনই


পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে টেট মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী। কমিটিতে মতবিরোধের কারণে মামলার নিষ্পত্তি আরও বিলম্বিত হতে পারে। রাজ্য সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত যদি নতুন সদস্য যোগ করে তবে নতুন করে প্রশ্ন মূল্যায়নের সম্ভাবনা তৈরি হবে। সবমিলিয়ে, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষক নিয়োগের জন্য এই মামলার রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।

Below Post Ad