সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে OBC (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি) সংরক্ষণ নীতিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য রাজ্যে কোনো কাজ সম্পূর্ণ করা যাচ্ছে না। বিশেষত স্কুল ও কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ের জেরে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। এই প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতার কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উপরেই একটি বড় ধরনের সংকট নেমে এসেছে।
বিতর্কের সূচনা: কীভাবে শুরু হল এই বিতর্ক?
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার ডিভিশন বেঞ্চ একটি ঐতিহাসিক রায়ে জানায়, রাজ্যের OBC বাতিল করা হবে যেখানে ২০১০ সালের আগে OBC হিসেবে স্বীকৃত ৬৬টি সম্প্রদায়ই কেবলমাত্র সংরক্ষণের সুবিধা পাবে। ২০১১ সালের পর তৃণমূল সরকারের আমলে যেসব সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেগুলিকে আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করে। এর পর থেকেই শুরু হয় রাজ্যে তোলপাড়।
এই রায়ের ফলে ২০১০ সালের পর ইস্যু হওয়া ওবিসি সার্টিফিকেটগুলো আপাতত সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈধ নয় বলে ধরা হচ্ছে। এর ফলে স্কুল ও কলেজে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে অসংখ্য প্রার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর রায়ের উপর অনেকের ভাগ্য নির্ভর করছে।
আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ চাইলেও শীর্ষ আদালত সেটি প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে সমস্ত OBC আপাতত বাতিল হিসাবেই গণ্য হয়ে রয়েছে । পরে রাজ্য সরকার জানায়, একটি নতুন সার্ভে চালু করা হয়েছে যাতে পুনরায় সমস্ত OBC তালিকাভুক্ত সম্প্রদায়গুলির সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাই করা যায়।
একটি কনটেম্পট মামলায় হাই কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, সরকার যদি আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে ২০১০ সালের পর ইস্যু হওয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করে নিয়োগ বা ভর্তি চালায়, তবে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই প্রেক্ষাপটে আদালত রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ক্ষমা চাইতে বলে।
বিচারপতি মান্থা আরও জানান যে, আদালতের কোনও স্থগিতাদেশ ভর্তি বা নিয়োগে নেই, তবু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই রায়কে কার্যত স্থগিতাদেশ ধরে নিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি করবে তারা বুজতে পারছি না।
ছাত্রছাত্রী ও ভর্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব
এই জটিলতার কারণে পশ্চিমবঙ্গের বহু স্কুল ও কলেজে ভর্তি কার্যক্রম থমকে গেছে। বিশেষ করে একাদশ শ্রেণি এবং কলেজের স্নাতক স্তরের ভর্তি এখন কার্যত ঝুলে রয়েছে। বেশ কিছু সরকারি বিদ্যালয়ে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, মেধা তালিকা প্রকাশ না করতে—যদিও কোনও লিখিত স্থগিতাদেশ নেই।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের কাছে পরামর্শ চায়, তখন তাদের জানানো হয়, আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। এই ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রশাসনিক বিভ্রান্তি ও নির্দেশনার অভাবের পরিচয় দেয়।
একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজ্যের প্রায় ৬০টি সরকারি স্কুল একাদশ শ্রেণির ভর্তি চালু করতে পারছে না। হুগলির একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক জানান, তাঁরা মেধা তালিকা প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না, কারণ রায়ের পর সংরক্ষণ নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন হলে, তা ছাত্রদের ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে।
সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বিরোধীদের অভিযোগ, ২০১১ সালের পর রাজ্য সরকার যেভাবে ওবিসি সম্প্রদায়ের সংখ্যা বাড়িয়েছিল, তা যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক যাচাই ছাড়াই করা হয়েছিল। এখন সেই একই সরকার আদালতের রায়কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভর্তি ও নিয়োগ স্থগিত করছে বলে অভিযোগ।
সরকারের সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সময়ক্ষেপণ এবং নতুন ওবিসি সমীক্ষা শুরু করাকে অনেকে ‘সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল’ বলেই মনে করছেন।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন
এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু গুরুতর প্রশ্ন সামনে আসছে:
- চলমান ভর্তি প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে?
- যাঁরা ২০১০ সালের পর ওবিসি সার্টিফিকেট পেয়েছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী?
- নতুন সমীক্ষা কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে?
এই সংকট শুধুমাত্র একটি আইনি বা প্রশাসনিক বিষয় নয়—এটি শিক্ষার মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত একটি মানবিক বিষয়। যদি ছাত্রছাত্রী ভর্তি থেকে বঞ্চিত হন, তা হলে তা তাঁদের শিক্ষা ও কর্মজীবনের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
স্বচ্ছতা ও দ্রুত পদক্ষেপের প্রয়োজন
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার, শিক্ষা দপ্তর এবং বিচার বিভাগকে মিলিতভাবে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজন নিচের পদক্ষেপগুলি:
- সুস্পষ্ট নির্দেশিকা: সমস্ত স্কুল ও কলেজকে লিখিতভাবে জানানো হোক, কীভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া চলবে।
- বিকল্প ব্যবস্থা: যাঁদের সার্টিফিকেট বর্তমানে অবৈধ ধরা হচ্ছে, তাঁদের জন্য অস্থায়ীভাবে শর্তসাপেক্ষে ভর্তি চালুর ব্যবস্থা করা হোক।
- খোলামেলা যোগাযোগ: সরকার ছাত্র-অভিভাবকদের সঙ্গে স্বচ্ছভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুক।
- স্বতন্ত্র মনিটরিং কমিটি: ওবিসি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের কথা ভাবা যেতে পারে।
উপসংহার
ওবিসি সংরক্ষণ সংক্রান্ত এই সংকট এখন শুধুমাত্র একটি রায়ের বিষয় নয়—এটি এখন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। আদালতের রায় সম্মান করেই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার—আর সেটিকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ভুলে বারবার থমকে দেওয়া কখনোই কাম্য নয়।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন দ্রুত সমাধান, স্পষ্টতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই এই সমস্যা সমাধানে দেরি করা চলবে না।